ছেলেমেয়েকে খুন করলাম, আমাকে পাওয়া যাবে রেললাইনে’

ডেস্ক রিপোর্ট ◑ বিটিসিএলের উপসহকারী প্রকৌশলী রকিব উদ্দিন ভূঁইয়া লিটন ঋণগ্রস্ত। এ নিয়ে হতাশায় ভুগছেন দীর্ঘদিন। পরিবারে ছিল অশান্তি। এ কারণে দুই শিশু সন্তানসহ স্ত্রী মুন্নি রহমানকে তিনি হত্যা করেছেন- এমন সন্দেহ পুলিশ ও নিহতের স্বজনের। হত্যারহস্য ঘুরপাক খাচ্ছে তাকে ঘিরেই। রকিবকে তাই খুঁজছে পুলিশ। মৃতদেহ উদ্ধারের সময় হত্যাকাণ্ড বিষয়ে লেখা পুলিশ একটি ডায়েরি জব্দ করেছে। তাতে লেখা আছে, ‘ছেলেমেয়ে ও স্ত্রীকে খুন করা হলো। আমাকে পাওয়া যাবে রেললাইনে।’ এই লেখাটি রকিবের বলে ধারণা পুলিশের। তবে তাকে গ্রেপ্তার না করা পর্যন্ত হত্যার কারণ ও কে বা কারা জড়িত এ ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো তথ্য পাচ্ছে না তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ।

গত শুক্রবার রাজধানীর দক্ষিণখানের প্রেমবাগান এলাকার পাঁচতলা বাড়ির চারতলার একটি ফ্ল্যাট থেকে মা মুন্নি, ১২ বছরের ছেলে ফারহান উদ্দিন ভূঁইয়া ও তিন বছরের মেয়ে লাইবার অর্ধগলিত মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। তিন-চার দিন আগে তাদের হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা পুলিশের। মুন্নিকে মাথায় আঘাত করে এবং দুই শিশুকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। মুন্নির মৃতদেহের পাশ থেকে একটি হাতুড়ি উদ্ধার করেছে পুলিশ। ওই হাতুড়ি দিয়ে মুন্নির মাথায় আঘাতের কারণে মাথার ভেতর গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। হত্যার ঘটনায় মুন্নির ভাই মুন্না রহমান বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করে গতকাল শনিবার দক্ষিণখান থানায় মামলা করেছেন। হত্যাকাণ্ডে একজন, নাকি একাধিক ব্যক্তি অংশ নিয়েছে, নিশ্চিত হওয়া যায়নি তা।

গতকাল শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ মর্গে মা ও দুই সন্তানের মৃতদেহ ময়নাতদন্ত করা হয়। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক কেএম মইন উদ্দিন সমকালকে বলেন, মুন্নির মাথায় পাঁচটি আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। হাতুড়ি দিয়ে পেটানো হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ছাড়া ছেলে ফারহানের গলায় চিকন ফিতা পাওয়া গেছে। এই ফিতা দিয়ে গলা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। মেয়েটিকে গলা টিপে ধরার চিহ্ন রয়েছে বলে জানান তিনি।

মুন্নির বাবার বাড়ি মহাখালীর ওয়্যারলেস গেটের টিঅ্যান্ডটি রোডে। তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার ছোট। বোনের দেবর রকিব উদ্দিন ভূঁইয়া লিটনের সঙ্গে প্রেম করে অন্তত ১৪ বছর আগে বিয়ে হয় তার। দক্ষিণখানের যে ফ্ল্যাট থেকে মুন্নি ও ২ সন্তানের মৃতদেহ পাওয়া গেছে ওই বাসায় ২০১১ সাল থেকে ভাড়ায় ছিলেন তারা। রকিব উত্তরা বিটিসিএলে উপ-সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত। বিটিসিএলের একজন কর্মকর্তা জানান, গত সপ্তাহে রকিব গুলশান থেকে উত্তরা বিটিসিএলে বদলি হয়ে এসেছেন। যোগদানের পর অফিস করেছেন কিনা তা তিনি জানাতে পারেননি। তবে ইতোমধ্যে পুলিশ রকিবের বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়েছে বিটিসিএলে।

মুন্নির মামাত ভাই তানভীর রহমান সমকালকে জানান, বিভিন ব্যক্তির কাছ থেকে মুন্নির স্বামী রকিব ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে পারেননি। ঋণ নেওয়া টাকা কী করেছেন, তা আত্মীয়স্বজন কেউ জানেন না বলে দাবি করেন তিনি। বলেন, মুন্নি-রকিবের পরিবার সুখের ছিল। ঋণগ্রস্ত হওয়ার পর অশান্তি শুরু হয়। কিন্তু এসব বিষয়ে মুন্নি আত্মীয়স্বজনকে কিছু জানাতেন না। যে কারণে কত টাকা ঋণ আছে, তা নিশ্চিত হওয়া না গেলেও টাকার অঙ্ক বড়। আর্থিক অনটন থাকায় ছেলে ফারহানকে এ বছর স্কুলে ভর্তি করাতেও পারেননি রকিব। ফারহান চতুর্থ শ্রেণি পাস করেছে। এবার পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার কথা ছিল। ঋণের কারণে চার-পাঁচ মাস আগে রকিব নিখোঁজ হন। পরে কুমিল্লার বুড়িচং এলাকা থেকে স্বজনরা তাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। তার নিখোঁজের বিষয়টি এখনও ধোঁয়াশা। প্রতিবেশী কারও কারও ভাষ্য, রকিব অনলাইনে জুয়া খেলতেন। এ কারণে তিনি ঋণগ্রস্ত হতে পারেন।

মুন্নির খালাত ভাই রাকিবুল ইসলাম সাকিব বলেন, ‘গত মঙ্গলবার খালা হাসিনা বেগম ও খালাত বোনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে মুন্নির কথা হয়। পরদিন বুধবার সকালে স্বজনরা তার ফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি। এক পর্যায়ে রিং বাজতে বাজতে মোবাইল ফোন বন্ধ হয়ে যায়। ধারণা করা হচ্ছে, চার্জ শেষ হয়ে যাওয়া ফোনটি বন্ধ হয়ে যায়। ফোনে না পাওয়ায় বুধবার বিকেলে খালা হাসিনা ও খালাত বোন সোনিয়া মুন্নিদের ফ্ল্যাটে গিয়ে দরজা বন্ধ পান। তারা ভেবে নেন, কোথাও বেড়াতে গেছে। শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত রকিব ও মুন্নির মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়ায় সন্দেহ হয় স্বজনদের। এর পরই মুন্নিদের ফ্ল্যাটে ছুটে যান তারা।

প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, মুন্নির স্বজনরা বাসায় আসার আগ থেকেই দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে বাসা থেকে। বাড়ির মালিকসহ প্রতিবেশীরা গন্ধের উৎস খুঁজতে দরজা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারেন। স্বজনরা দরজার তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকে খাটে মা ও মেয়ে এবং পাশের ঘরের দরজার পাশে মেঝেতে ছেলের মৃতদেহ দেখতে পেয়ে আঁতকে ওঠেন। খবর পেয়ে দক্ষিণখান থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। রাতে মৃতদেহ তিনটি উদ্ধার করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়।

দক্ষিণখান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) নাসির উদ্দিন সমকালকে বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে দুই সন্তানসহ মুন্নিকে রকিব খুন করেছে। তাকে গ্রেপ্তার করতে অভিযান শুরু হয়েছে।’